প্রাচীন বাংলার জনপদ প্রাচীন যুগে বাংলা বিভিন্ন জনপদে বিভক্ত ছিল এবং এই জনপদবাসীরাই স্ব-স্ব। জনপদের নামেই পরিচিতি লাভ করে। তবে ভৌগোলিক পরিবেশ একদিকে যেমন প্রাকৃতিক পরিবর্তনের (নদীর ভাঙা-গড়া) সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে ঠিক একইভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা বিস্তার বা হ্রাসের মাধ্যমে। জনপদগুলোর আয়তনও পরিবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে এসব পৃথক পৃথক অংশগুলো এককথায় জনপদ নামে পরিচিতি লাভ করেছে।
টেবিল অনুসারে দেখুন
নির্দেশনা (সংকেত/ধাপ/পরিধি):
- ক) প্রাচীন বাংলার মানচিত্র অঙ্কন করে জনপদগুলাে চিহ্নিত করা;
- খ) জনপদগুলাের গুরুত্ব ব্যাখ্যা;
- গ) প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের ধারণা ব্যাখ্যা;
- ঘ) শিক্ষার্থীর বর্তমান নিজ জেলা যে জনপদে অন্তর্ভুক্ত ছিল তাঁর ব্যাখ্যা;
প্রাচীন বাংলার মানচিত্র অঙ্কন করে জনপদগুলাে চিহ্নিত করা
* মানচিত্রে প্রাচীন বাংলার জনপদ **
* বঙ্গ- কুষ্টিয়া, যশোর, নদীয়া, ঢাকা, ফরিদপুর ও ময়মনসিংহ।
* সমতট- কুমিল্লা ও নোয়াখালী।
* হরিকেল- পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, ত্রিপুরা ও সিলেট।
* গৌড়- চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোর, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুর।
* বরেন্দ্র- বগুড়া, পাবনা ও রাজশাহীর অংশবিশেষ।
* পুণ্ড্র- বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুর-দিনাজপুর জেলার অংশ।
চন্দ্রদ্বীপ- বরিশাল (বাকলা, ইসলামপুর)।
প্রাচীন জনপদের গুরুত্ব
পুণ্ড্র নামক এক জাতি পুণ্ড্র জনপদ গড়ে তুলেছিল। বগুড়া, দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা জুড়ে পুণ্ড্রনগর বিস্তৃত ছিল । পাণিনির গ্রন্থে সর্বপ্রথম গৌড়ের উল্লেখ পাওয়া যায়। আধুনিক মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম ও বর্ধমানের কিছু অংশ গৌড়ের সীমানা বলে মনে করা হয়। গঙ্গা ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মােহনা পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল সমতট নামে পরিচিত।
বরেন্দ্র উত্তরবঙ্গের একটি জনপদ। গঙ্গা ও জবুর উত্তরবঙ্গের এবং করতােয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে ছিল এ জনপদের অবস্থান। হরিকেলের দক্ষিণে অবস্থিত ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদ। চন্দ্রদ্বীপ একটি ক্ষুদ্র জনপদ। এই প্রাচীন জনপদটি বালেশ্বর ও মেঘনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত ছিল। বাংলার সীমানা চিহ্নিতকরণ ও ইতিহাস পুনর্গঠনে উক্ত জনপদগুলাের গুরুত্ব অপরিসীম।
বিভিন্ন সভ্যতার নিদর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের নিগুঢ় তত্ত্ব উঘাটন করা যায়। যেমন বাংলাদেশে প্রাপ্ত পাথরের চাকতিতে খােদাই করা প্রাচীনতম শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, পুড় ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে সমৃদ্ধ জনপদ। বগুড়া থেকে সাত মাইল দূরে মহাস্থানগড় প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধন নগরীর ধংসাবশেষ বলে পণ্ডিতরা অনুমান করেন।
সমতট নামক জনপদটিকে কেউ কেউ মনে করেন এটি বর্তমান কুমিল্লার প্রাচীন নাম। কুমিল্লার ময়নামতিতে কয়েকটি প্রাচীন নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া গেছে। শালবন বিহার এগুলাের অন্যতম। তাম্রলিপ্ত প্রাচীনকালে গুরুত্বপূর্ণ নৌ-বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। চন্দ্রদ্বীপ ছিল বরিশাল জেলার পূর্ব নাম।
এভাবে জনপদগুলাে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধানে সহায়তা করছে। প্রাচীন বাংলার জনপদ থেকে আমরা সে যুগের বাংলার ভৌগােলিক অবস্থা, সীমারেখা, রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি সম্পর্কে মােটামুটি ধারণা লাভ করতে পারি। প্রাচীন বাংলায় তখন কোনাে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল না। শক্তিশালী শাসকরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে একাধিক জনপদের শাসন ক্ষমতা লাভ করতেন। এভাবে জনপদগুলাে প্রাচীন বাংলায় প্রথমে ভূখণ্ডগত ইউনিট বা প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ভূমিকা পালন করে এবং পরবর্তী সময় রাজনৈতিক ঐক্য গঠনে সহায়তা করেছিল।
গ) প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের ধারণা ব্যাখ্যা
ইতিহাসে প্রাচীন কাল একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যুগ বা পর্ব। এই পর্বটিতে যে কোনাে সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক রূপের কিছু প্রকাশ ঘটেছিল। প্রাচীন যুগকে তাই কোনাে রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। সাধারণত ইতিহাসে খ্রিস্টপূর্ব কয়েক শতাব্দী আগের সময় থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীকেই প্রাচীনকাল বা যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে। তবে অঞ্চলভেদে এই সময়ের মধ্যে তারতম্যও লক্ষ করা যায়। আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব, বিকাশ ও প্রভাবের কার্যকারিতা নিয়েই এ যুগ বিভাজন নির্ণয় করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ভূখন্ডে খ্রিস্টীয় তের শতকের আগ পর্যড় দীর্ঘ প্রায় দুই হাজার বছর সময়কে প্রাচীন যুগ বলে ধরা হয়ে থাকে।
ক. জনবসতি:
বাংলায় জনবসতি স্থাপন শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব দশ হাজার বছরেরও পূর্ব থেকে নগ্রোয়েড, ইউরােপয়েড এবং মঙ্গোলয়েড জাতিগােষ্ঠীর (Race) নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, অ্যালােপাইন, আর্য, মঙ্গোলীয়, শক, তুর্কি, আরব পাঠান, হাবশ, কোচ, রাজবংশী, পর্তুগিজ প্রভৃতি জাতিগােষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে বাংলার জনস্রোতে মিশেছিল। অস্ট্রিকরাই এখানে কৃষি ও পশুপালনের সূচনা করেছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। কোল, ভিল, সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি জনগােষ্ঠী অস্ট্রিকদের বংশধর।
খ. কোম সমাজ:
দলবদ্ধ জীবনই সমাজ। প্রাচীন বাংলায় কোমই (গােত্র) হচ্ছে সুসংগঠিত প্রথম দলবদ্ধ সমাজ। বিভিন্ন নরগােষ্ঠী সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র সত্তা ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে কোম জীবন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। আদিতে শিকার, কোম কৃষি এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গৃহশিল্পই ছিল সামাজিক সম্পদের প্রধান উৎস। তখন অবশ্য ধনসাম্য প্রথা কার্যকর ছিল। এর অর্থ হচ্ছে শিকার, কৃষি ও গৃহশিল্পে কোমের সদস্যরা ভাগাভাগি (ক্ষুধা নিবারণের জন্য যতটুকু প্রয়ােজন) করে নিত। অবশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক আদান-প্রদান রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে ছােট-বড় কোমের সমবায়ে বৃহত্তর কোমের (বঙ্গ, সুক্ষা, পুন্ডা, কলিঙ্গ, রাঢ় ইত্যাদি) উদ্ভব ঘটেছে
গ. প্রাচীন বাংলায় বর্ণ-প্রথা:
কোনাে সমাজে বর্ণপ্রথা একেবারে শুরুতে থাকে না। এটি সমাজ ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসেবে সৃষ্টি হয় আর্য সংস্কার ও সংস্কৃতির বিস্তার হিসেবেই বর্ণপ্রথা বাংলা তথা ভারতীয় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আর্যপূর্ব ও অনার্য সংস্কার এবং সংস্কৃতি এ বর্ণপ্রথার ভাবাদর্শে পুষ্ট হয়েছিল। বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের মতােই বাংলা ভুখন্ড বর্ণশ্রম এবং বিভক্তির সর্বগ্রাসী ব্যবস্থায় বেড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এ চতুর্বর্ণের প্রথাকে আরাে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে প্রাচীন ধর্মসূত্র ও স্মৃগ্রিন্থের লেখকরা ভুমিকা রাখেন। নারী – পুরুষের অবস্থান প্রাচীন বাংলায় নারী পুরুষের বৈষম্য একটি সাধারণ বিষয় ছিল। তবে ধনী উচ্চকোটি পরিবারের নারীদের অবস্থান পশ্চাৎপদদের চেয়ে অনেক ভালাে ছিল।
সাধারণভাবে গৌড়ে নারীদের মৃদুভাষিণী, অনুরাগবর্তী বলা হতাে। বর্ণপ্রথার কারণে অসবর্ণ বিবাহ সমাদৃত ছিল না । তবে উচ্চ পরিবারে তা সবার ক্ষেত্রে মানা হতাে না। পাল ও সেন আমলে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। মা ও স্ত্রীদের সম্মান বেশ উঁচুতে ছিল। নারীরা ঘরকন্না ছাড়াও বিভিন্ন কাজে যুক্ত ছিল। অভিজাত পরিবারে শিশু ধাত্রীর কাজেও নারীরা যুক্ত হতাে। সুতা কাটা, তাঁত বুনা, অন্যান্য গৃহশিল্পকর্মে নিয়ােজিত হতাে দরিদ্র পরিবারের নারীরা।
আমার জেলা যে জনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিল তার বর্ণনা নিম্নরুপ
আমার জেলার নাম সিলেট । সিলেট জেলা প্রাচীনে হরিকেল জনপদের অন্তর্ভূক্ত ছিল।
নিচে হরিকেল জনপদের ব্যাখ্যা উপস্থাপন করা হলাে হরিকেল:
হরিকেল জনপদের কথা প্রথম জানা যায় প্রথম শতকের চট্টগ্রামে প্রাপ্ত লিপিতে। চন্দ্রবংশীয় লিপিতেও হরিকেল রাজ্যের কথা আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত দুটি প্রাচীন গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে হরিকোল (হরিকেল) ও বর্তমান সিলেট বিভাগ অভিন্ন উল্লিখিত হয়েছে। অনেকে ধারণা করেন যে হরিকেল জনপদ ছিল না, এটি বঙ্গের সাথে যুক্ত ছিল।